ধোঁয়াবিহীন তামাকে গর্ভবতীর স্বাস্থ্যঝুঁকি

তামাক একটি নেশাদায়ক দ্রব্য, যার মূল উপাদানটি হলো নিকোটিন। এ নিকোটিন সাধারণত দুই উপায়ে আমাদের শরীরে ঢোকে। প্রথমত নিকোটিন পুড়িয়ে সিগারেট, বিড়ির ধোঁয়ার মাধ্যমে। আর দ্বিতীয়ত ধোঁয়াবিহীন জর্দা, গুল, সাদাপাতা, গুটকা, খৈনি, পানমশলা ও পানপাতার সঙ্গে চিবিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় উপায়ে তামাক গ্রহণ আমাদের সমাজের বহু পুরনো একটি রীতি। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও এই সামাজিক রীতি বহাল তবিয়তে টিকে থাকে আমাদের ব্যক্তিগত অনুশীলন এবং অন্যদিকে সতর্কীকরণ উপায়গুলোতে বৈষম্য থাকার কারণে।

গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১ কোটি ৯২ লাখ ধূমপায়ীর মধ্যে (১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব) শতকরা ৩৬.২ ভাগ পুরুষকে (সেখানে নারী মাত্র ০.৮ ভাগ) সতর্ক করার জন্য প্রত্যেক দামি, কমদামি সিগারেট-বিড়ির প্যাকেটে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ লেখা সতর্কীকরণ বার্তা পাওয়া যায়। অথচ ধোঁয়াবিহীন তামাক গ্রহণে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক এগিয়ে। কিন্তু সেই নারীদের মাতৃস্বাস্থ্যবিষয়ক সতর্কবার্তা ‘ধোঁয়াবিহীন তামাকের প্যাকেট’-এ খুব একটা দেখা যায় না।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখই অভ্যস্ত মূলত ধোঁয়াবিহীন তামাকে (গ্যাটস, ২০১৭)। এ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীর মধ্যে পুরুষ হচ্ছে শতকরা ১৬.২ ভাগ আর নারী হচ্ছে ২৪.৮ ভাগ। অর্থাৎ ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার নারী নিয়মিত ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করছেন (গ্যাটস, ২০১৭)। ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের একটি গবেষণায় আসে বাংলাদেশের শতকরা ২০ ভাগ প্রজননক্ষম নারী ধোঁয়াবিহীন তামাক গ্রহণ করেন। অন্যদিকে স্টেপস ২০১৩ সালে তাদের রিপোর্টে জানায়, দেশে ২৫ বা তদূর্ধ্ব নারীদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের হার শতকরা ২৯.৫ ভাগ (হক ও অন্যান্য, ২০১৭)। সংখ্যায় যাই হোক না কেন, একজন মানুষের নিয়মিত তামাক সেবনই যেখানে স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় ভয়াবহ হয়ে থাকে তাহলে গর্ভবতী নারীর তামাক সেবন যে নিঃসন্দেহে মারাত্মক আশঙ্কাজনক, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০১০-১১ সালের মধ্যে পরিচালিত ঢাকা মেডিকেল কলেজের পেডিওট্রিকস, অবস্টেট্রিকস ও গাইনি বিভাগের এক গবেষণা থেকে জানা যায় শতকরা ৪৬ ভাগ প্রিম্যাচিওর বাচ্চার মায়েরা গুল এবং ২১.৭৩ ভাগ বাচ্চার মায়েরা জর্দা খান (মুনমুন ও অন্যান্য, বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ সাময়িকী, ২০১৬)। এ ভয়াবহতার গুরুত্ব বোঝা যায় তামাক নিয়ন্ত্রণ সংশোধনী আইন-২০১৩ এর ১০নং ধারায় তামাক পণ্য প্যাকেটজাতকরণে কিছু সচিত্র সতর্কীকরণ নির্দেশনাবলিতে। যেখানে ¯পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের প্যাকেটে ‘তামাক গ্রহণ গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর’ কথাটি উল্লেখ করতে হবে। তাছাড়া প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ধূমপান যে গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর সে বিষয়েও স্পষ্ট বলা আছে। তামাক পণ্যের গায়ে সতর্কীকরণ চিত্র ছাপানো বাধ্যতামূলক করা হয়, যাতে সমাজের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তামাকদ্রব্য ব্যবহারের ভয়াবহ দিক প্রচার করে তাদের সতর্ক করা সম্ভব হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধোঁয়াযুক্ত তামাক কিংবা বিড়ি-সিগারেট খাওয়া নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন বা সচেতন হই অথবা না খাওয়ার জন্য প্রচারণায় উচ্চকিত হই, কিন্তু একইরকম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি ক্ষতিকর ‘ধোঁয়াবিহীন তামাক’ গ্রহণের বিষয়ে ততটাই উদাসীন। এটা আমাদের জন্য বিশেষত, নারী তথা মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা উপেক্ষিতই থাকে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে ‘গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ-২০১৭’-এর প্রতিবেদনে। সেখানে উত্তরদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে কমসংখ্যক মাত্র শতকরা ১৬.১ ভাগ বলেছিলেন তারা তামাক গ্রহণের সঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতিবিষয়ক সতর্কীকরণ চিত্র খেয়াল করেছেন। এছাড়া শতকরা ৭১.৪ ভাগ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারী প্যাকেটের গায়ে যে চিত্রটি দেখে তামাক ছাড়তে চেয়েছেন তা হলো ধূমপান গ্রহণে মুখ ও গলায় ক্যানসার হয় (গ্যাটস, ২০১৭)।

গবেষণার সুবিধার্থে আমরা বাজার থেকে বেশকিছু জর্দা ও গুলের নমুনা সংগ্রহ করি। নমুনাগুলোর মধ্যে অধিকাংশের গায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তো দূরে থাক, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ ঠিকানাও পর্যন্ত নেই। যে অল্পসংখ্যক নমুনায় স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা লেখা আছে তা শুধু মুখ ও গলার ক্যানসারের কথাতেই সীমাবদ্ধ। যে দুয়েকটি কৌটার গায়ে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতিবিষয়ক চিত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও ¯পষ্ট নয় যা সম্পূর্ণভাবে দেশের প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পরিপন্থী।

দৈনিক প্রথম আলোর (২০২০) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তামাকজাত পণ্যে প্রতি ১ গ্রামে গড়ে ৪৬ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোসেমিন এবং ৩১ মাইক্রোগ্রাম নিকোটিন পাওয়া গেছে। এ কথা প্রমাণিত যে, গর্ভাবস্থায় তামাক সেবনের কারণে মা ও গর্ভস্থ শিশু উভয়েরই ক্ষতি হয় (দ্য ল্যানসেট, ২০১৪)। এসব ক্ষতির মধ্যে গর্ভাবস্থার জটিলতা (যেমন, প্লাসেন্টা প্রেভিয়া একটি জটিল অবস্থা যখন গর্ভাবস্থায় গর্ভফুলটি জরায়ুর একদম নিচের দিকে বা জরায়ুমুখে লেগে থাকে, প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন গর্ভফুলের ছেদন এবং প্রাক-এক্ল্যাম্পসিয়া গর্ভবতী মহিলাদের এমন এক রোগ যেখানে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং প্রস্রাবের সঙ্গে প্রচুর প্রোটিন নির্গত হয় নতুবা অন্যান্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়) এবং ভ্রƒণের ক্ষতি (যেমন কম ওজন, অকাল জন্ম, জন্ম-পরবর্তী মৃত্যুর হার বৃদ্ধি) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যদিও গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার (যেমন নস্যি বা তামাক পাতা চিবানো) কী ক্ষতি করে সে বিষয়ে খুবই কম আলোচনা করা হয় তবে এগুলো মৃতসন্তান প্রসব, নির্ধারিত সময়ের আগেই সন্তান প্রসব এবং কম ওজনের শিশু জন্মদানের জন্য দায়ী বলে জানা যায় (দ্য ল্যানসেট, ২০১৪)।

একজন মা তার সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। তাকে যদি বোঝানো সম্ভব হয় তার একটি অভ্যাস তার গর্ভের সন্তানের জন্য ক্ষতিকর তিনি নিশ্চয় তা থেকে বিরত থাকবেন। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রয়োজন ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের প্যাকেটে সতর্কীকরণ চিত্রসহ বার্তাটি সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা। কেননা যে মা তার রক্তে নিকোটিন নিয়ে গর্ভের সন্তানকে বড় করে তুলবেন, সেই সন্তানটির নিকোটিনজনিত শারীরিক ও মানসিক জটিলতা নিয়ে আজ আর কোনো সন্দেহ নেই।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০২১-এ বলা হয়েছে, এ বিশ্ব থেকে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে আরও ১৩৫ বছর লাগবে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ ধাপ পিছিয়ে ৬৫তম স্থানে গেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতি, শিল্প বা কারিগরি দক্ষতায় লিঙ্গবৈষম্য ওই আলোচনায় স্থান পেলেও, তামাকাজাত পণ্যের সতর্কবার্তায় নারী ও পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছে।

কিন্তু যে নারীর গর্ভে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠবে আমরা কি তাকে অবহেলা করতে পারি?

লেখকবৃন্দ : যথাক্রমে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং শিক্ষার্থী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *