স্বাস্থ্যের উন্নতির পথে বাধা অসমতা

অর্জনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যে অনেক অন্যায্যতা আছে। এ নিয়ে আলোচনা কম হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য এই অসমতা নিয়ে।

মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসব যদি বাড়িতে হয়, তাহলে নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। অর্থাৎ প্রসব যদি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, হাসপাতালে বা ক্লিনিকে হয়, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে। সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০১৭-১৮) তথ্য বলছে, শহরের ৬৩ শতাংশ প্রসব হয় স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে। আর গ্রামে এই হার ৪৫ শতাংশ।
অর্থাৎ সন্তান জন্মের সময় নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুঝুঁকি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি।

এই অসমতা ও বৈষম্যের তথ্য উঠে এসেছে একাধিক বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ, মাতৃস্বাস্থ্য ও মাতৃমৃত্যু জরিপে। স্বাস্থ্যে এ ধরনের অসমতা আছে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে, আছে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে, দেখা যায় দরিদ্র ও ধনী শ্রেণির মধ্যে। আছে আঞ্চলিক বৈষম্য। বাংলাদেশের সব বিভাগের শিশুরা সমান হারে জীবন রক্ষাকারী টিকা পায় না। মা যে সমাজেরই হোন, তিনি যদি নিরক্ষর হন, তাহলে তাঁর সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি থাকে।

স্বাস্থ্য খাতের নানা ধরনের অসমতা ও বৈষম্য দূর করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বলে চোখে পড়ে না। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রায় বিনা মূল্যে থেকে স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগ পর্যন্ত সর্বস্তরের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আছে। এটি করাই হয়েছে যেন সব ধরনের বৈষম্য রোধ করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।’

এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৭ এপ্রিল বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে এ বছর দিবসটি পালন উপলক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি। এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘সকলের জন্য ন্যায্য, স্বাস্থ্যসম্মত বিশ্ব গড়ে তোলা’।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক আহমেদ মোস্তাক রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অসমতা বা বৈষম্যের কিছু কারণ আমাদের সমাজে বা স্বাস্থ্যব্যবস্থায় গভীরভাবে প্রথিত। এসব অসমতা দূর করার ইচ্ছা থাকতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এই অসমতা দূর করা সম্ভব নয়। কিছু অসমতা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব না হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সোচ্চার হওয়া দরকার।’

শিশুস্বাস্থ্যে বৈষম্য

বাংলাদেশে শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ইপিআই সারা দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু সব বিভাগের শিশুরা টিকা সমান হারে পাচ্ছে না।

টিকা পাওয়ার হার সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগের শিশুদের। ১২ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের টিকা পাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা কার্যালয় দেখেছে, সিলেট বিভাগের ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু টিকা পায়। সবচেয়ে বেশি হারে টিকা পায় রাজশাহী বিভাগের শিশুরা, ৯৩ দশমিক ১ শতাংশ। টিকা পাওয়ায় এগিয়ে খুলনা, রংপুর ও ঢাকা বিভাগের শিশুরা। আর পিছিয়ে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের শিশুরা।

মাতৃস্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, শিশুমৃত্যু হার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। এই বিভাগে ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৫টি শিশু মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগে এই হার ৪৮।

শিশুস্বাস্থ্যে বৈষম্যের বিষয়টি অন্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। শিশুস্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর উচ্চতা, ওজন। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, শহরের ২৫ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। গ্রামে এই হার ৩৩ শতাংশ। আবার এই হার সবচেয়ে বেশি শহরের বস্তি এলাকার শিশুদের মধ্যে।

দারিদ্র্য স্বাস্থ্যের শত্রু

দরিদ্র অবস্থা সব বয়সী মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক না কেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের উচ্চতা কম। জনস্বাস্থ্যবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা ধনী ও দরিদ্র পরিবারগুলোকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে ধনী শ্রেণির পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে খর্বতার হার (বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা) ১৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে এই হার ৪০ শতাংশ।

সরকারের তথ্য বলছে, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহারও বেশি। সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণির পরিবারে জন্ম নেওয়া ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৬২টি শিশু মারা যায় বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। সমাজের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোতে শিশুমৃত্যুর এই হার ৩০। অর্থাৎ ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।

শুধু শিশু নয়, বৈষম্যের শিকার মায়েরাও। ২০১৮ সালের হিসাব বলছে, সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণির ৮২ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসবপূর্ব সেবা পান। সে দিক থেকে সবচেয়ে ধনী শ্রেণির গর্ভবতী মায়েরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। এই শ্রেণির ৯৯ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসবপূর্ব সেবা পাচ্ছেন।

নারীর ঝুঁকি বেশি

দরিদ্র অবস্থা সব বয়সী মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক না কেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের উচ্চতা কম। জনস্বাস্থ্যবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা ধনী ও দরিদ্র পরিবারগুলোকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে ধনী শ্রেণির পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে খর্বতার হার (বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা) ১৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে এই হার ৪০ শতাংশ।

সরকারের তথ্য বলছে, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহারও বেশি। সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণির পরিবারে জন্ম নেওয়া ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৬২টি শিশু মারা যায় বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। সমাজের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোতে শিশুমৃত্যুর এই হার ৩০। অর্থাৎ ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।

শুধু শিশু নয়, বৈষম্যের শিকার মায়েরাও। ২০১৮ সালের হিসাব বলছে, সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণির ৮২ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসবপূর্ব সেবা পান। সে দিক থেকে সবচেয়ে ধনী শ্রেণির গর্ভবতী মায়েরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। এই শ্রেণির ৯৯ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসবপূর্ব সেবা পাচ্ছেন।

নারীর ঝুঁকি বেশি

দেশে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। ডায়াবেটিসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে শহরের ধনী শ্রেণির নারীদের মধ্যে।

দেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে। তাতে দেখা যায় ৩৫ বছরের বেশি বয়সী ৩৮ শতাংশ পুরুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। একই বয়সী নারীদের মধ্যে এই হার বেশি, ৪৫ শতাংশ।

উচ্চ রক্তচাপের এই প্রবণতা শহরে ও গ্রামে দুই জায়গাতেই নারীদের মধ্যে বেশি। শহরের ৩৫ বছরের বেশি বয়সী ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। একই বয়সী শহরের পুরুষের মধ্যে এই হার ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ।

চলমান মহামারির সময় দেখা গেছে, নারীদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে করোনার টিকা নেওয়ার জন্য শহরের বস্তিবাসীরা নিবন্ধন কম করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্য খাতের এসব অসমতা শুধু অন্যায্য বা পক্ষপাতদুষ্ট তাই নয়, এত দিনের স্বাস্থ্য খাতের অর্জনও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করলে এ ধরনের অন্যায্যতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য থেকে আরও পড়ুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *